বিদায় হজ্জেরর ভাষণ এবং তাৎপর্য

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক দশম হিজরির জিলহজ মাসে বিদায় হজ পালনকালে এই মাসের ৯ তারিখে বিকেলে আরাফাতের ময়দানে লক্ষাধিক সাহাবিদের সামনে বক্তব্য পেশ করেছিলেন।  তাঁর এই বক্তব্য বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে পরিচিত। আমরা আজকে এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাল্লাহ।

আরাফাতের ময়দান

 সূচিপত্রঃ-বিদায় হজ্জের ভাষণ এবং তাৎপর্য।

  • ভুমিকা। 
  • বিদায় হজ্জের ভাষণ কত তারিখে হয়েছিল? 
  • বিদায় হজ্জের ভাষণ কোথায় হয়েছিল? 
  • বিদায় হজ্জের ভাষণ (সারসংক্ষেপ)।
  • বিদায় হজ্জের ভাষণের তাৎপর্য।
  • শেষ কথা। বিদায় হজ্জেরর ভাষণ এবং তাৎপর্য।

বিদায় হজ্জের ভাষণ কত তারিখে হয়েছিল? 

দশম হিজরির জিলহজ মাসে বিদায় হজ পালন করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই মাসের ৯ তারিখে হজ্জ পালনকালীন বিকেলে আরাফাতের ময়দানে এবং পরদিন ১০ জিলহজ কোরবানির দিন লক্ষাধিক সাহাবির সামনে বক্তব্য পেশ করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই দুই দিনে দেওয়া তাঁর বক্তব্য বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে পরিচিত। 

আর পড়ুনঃ কিয়ামতের আলামত এবং লক্ষণ – এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানুন

বিদায় হজ্জের ভাষণ কোথায় হয়েছিল? 

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কর্তৃক হজ্জের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে অনুচ্চ জাবাল-এ-রাহমাত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবিতকালে এটাই শেষ ভাষণ ছিলো, তাই সচরাচল এটিকে বিদায় হজ্জের ভাষণ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।


বিদায় হজ্জের ভাষণ (সারসংক্ষেপ)


১। মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।
২। হে বিশ্বাসীগণ। স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে।
৩। সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে ও সুদ খাবে না।
৪। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে না।
৫। মনে রেখ। দেশ, বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহ ভীতি ও সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই সবচাইতে সেরা, যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
৬। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। পূর্বের অনেক জাতি একারণেই ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। বরং তার আনুগত্য করবে।
৭। দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরকেও তা আহার ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোনো অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে, তবুও তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারাও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
৮। জাহিলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো, তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য। আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। এগুলো যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।
৯। আমিই শেষ নবি। আমার পর কোনো নবি আসবে না।
১০। হে জনতা, আমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শোন, আমি জানি না, এবারের পর তোমাদের সঙ্গে এ জায়গায় আর একত্র হতে পারব কি না।
১১। তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।

 

তারপর হযরত মুহাম্মদ (স.) আকাশের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি? সাথে সাথে উপস্থিত জনসমুদ্র থেকে আওয়াজ এলো, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই পেরেছেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (স.) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। এরপরই আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন-

 

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَالْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا .

 

অর্থ: "আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম" (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৩)।

আর পড়ুনঃ সাহাবীদের নাম অর্থসহ ছেলেদের - পুরুষ সাহাবীদের নামের তালিকা অর্থসহ

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। উপস্থিত জনতাও নীরব থাকল। অতঃপর সকলের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, 'আল-বিদা' (বিদায়)। 

বিদায় হজ্জের ভাষণের তাৎপর্য।


এই ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিলো। মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল উপাসনামূলক অনুশাসন ছিলো না, বরং মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও এতে ছিলো। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার সার্বভৌমত্বের সাহ্ম্য, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই এই ভাষণের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। 

এই ভাষণে তাকওয়া বা দায়িত্বনিষ্ঠতার কথা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিলো এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব বা হক্কুল্লাহ ও মানবসম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব বা হক্কুল ইবাদের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছিলো। । 


নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এই ভাষণে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন, বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের ওপর জোর দেয়া হয়েছিলো। মুহাম্মদের এই ঐতিহাসিক ভাষণে স্বর্গ-মর্ত্যের সকল কিছুর ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিলো এবং মানুষকে এসবকিছুর আমানতদার হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর মালিকানায় সবার অধিকার স্বীকৃত বলে উত্তরাধিকার আইনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো। আমানতের খেয়ানতকারীর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিলো। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব এবং বদান্যতা ও মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো।

শেষ কথা। বিদায় হজ্জেরর ভাষণ এবং তাৎপর্য।

আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কর্তৃক বিদায় হজ্জের ভাষণ দিয়েছিলেন। যা আমাদের জিবনের পাথেয় বলে স্বীকার করতে হবে। আমরা যদি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক যে সকল নির্দেশনাগুলো প্রদান করেছেন তা কঠোরভাবে পালন করি তাহলে আমাদের পারিবারিক ও সাংসারিক জীবন সার্থক ও সুন্দর হবে ইনশাআল্লাহ। 

যদি আমাদের এই ক্ষুদ্র লেখা আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনাদের প্রিয়জনকে শেয়ার করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। মএহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলের হন (আমিন)।






এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url