গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে - গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কেনো হয়
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্বল্পোন্নত দেশে গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার হার ব্যাপক হারে দেখা যায়। এটি একটি মারাত্মক অবস্থা নারীদের গর্ভকালীন সময়ে। প্রায় 20% নারীর মৃত্যুহার রয়েছে এই গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতাজনিত কারণে। তাই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া আমাদের অত্যন্ত জরুরি। আজকে আমরা জানবো গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে।
সেই সাথে এই সমস্যার কারণ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করার চেষ্টা করব। আশা করছি এই একটি আর্টিকেল এর মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় তৈরি হওয়া রক্তশূন্যতা জনিত নানাবিধ জটিলতার অবসান ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ পেয়ে যাবেন। চলুন দেখে নেয়া যাক গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কেনো হয়
গর্ভধারণ করা নারীদের একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার সময় নানাবিধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। তন্মধ্যে রক্তশূন্যতা একটি জটিলতম সমস্যা। গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী নারীর দেহে প্রয়োজনীয় লৌহ বা আয়রন না থাকার কারণে রক্তশূন্যতা হয়।
এছাড়া পুষ্টিহীনতা ও ঘন ঘন সন্তান জন্মদান এই সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। জমজ শিশু জন্মদানেও এই সমস্যা বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে। খাদ্যাভাসে ও খাদ্যের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে কম ধারনা থাকায় এ সমস্যা হতে পারে। রক্তশূন্যতার কারণে শরীরে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়। রক্তের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত নারীদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের কম উপস্থিতি থাকে। হিমোগ্লোবিন দেহের কোষ গুলোকে কর্মক্ষম ও সক্রিয় রাখতে সহায়তা করে। এর অভাবে শরীরে গর্ভাবস্থায় জটিলতার সৃষ্টি হয়। আগে থেকেই রক্তস্বল্পতা থাকলে গর্ভাবস্থার পর সেটি বৃদ্ধি পেতে পারে।
অনিয়মিত বা ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে শরীরের সুষম পুষ্টির অভাবে রক্তশূন্যতা হতে পারে। অনেক গর্ভবতী নারী অতিরিক্ত ভাজাপোড়া বা জাঙ্ক ফু ড খেয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে রক্তশূন্যতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় কি খাওয়া যাবে - গর্ভবতী মায়ের কোন খাবার গুলো খাওয়া উচিত
প্রধানত গর্ভধারণের কারণেই রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে কারণ এই সময়ে শরীরের বিভিন্ন জলীয় উপাদান বৃদ্ধি পায়। এ সময় রক্তের লোহিত কণিকা তৈরিতে বিলম্ব ঘটে। এই কারণেও রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে।
শরীরে নতুন কোষ তৈরি করতে দরকার হয় ফোলেট,যা এক ধরনের ভিটামিন বি। ফোলেট এর অভাবেও রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এর অভাবে দেহের স্বাস্থ্যকর লোহিত কণিকার পরিমাণ কমে যায়। এর কারণে জন্মের সময় কম ওজনের শিশুর জন্মদানের মত মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। শরীরে আয়রন যুক্ত খাবারের পরিমাণ কমে গেলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
রক্তশূন্যতার কারণে শরীরে যেসব সমস্যা দেখা দেয়
প্রাথমিক পর্যায়ে হয়তো রক্তস্বল্পতার জন্য আপনি উল্লেখযোগ্য কোন উপসর্গ লক্ষ্য নাও করতে পারেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তশূন্যতা নির্ণয় করা সঠিক হবে বলে ধারণা করা যায়। নিম্নে বর্ণিত সমস্যাগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতা হলে দেখা যেতে পারে।
- সামান্য পরিশ্রমে শরীরে ক্লান্তি চলে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে ,চোখ সাদা হয়ে যায় ও ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখ ধারন করে।
- বমি বমি ভাব আসে, ক্ষুধা মন্দা দেখা যায় ও শরীর দুর্বল লাগে।
- রক্তশূন্যতা বেশি হলে বুক ধরফর করতে পারে , মুখে ও জিহ্বায় ঘা হয়।
- পা ফুলে যেতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট সমস্যা দেখা দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রক্ত শূন্যতার ক্ষতিকর প্রভাব
এ সমস্যা দেখা দিলে শিশুর ভ্রূণ বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় প্রসবকালীন সময়ে কিংবা তারপরে। মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে শিশু প্রসব হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া শারীরিক দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া, শরীরে পানি আসা সহ নানা বীধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া জন্মের আগে জরায়ুতেই শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। মাতৃ হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
যেকোনো কিছুতে মনোযোগ আনতে সমস্যা হয়।তাই এই বিষয়ে আমাদের অধিকতর সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে
যে সমস্ত খাবার খেলে শরীরে লৌহ আয়রন এর ঘাটতি পূরণ করা যায় সে সকল খাবারের তালিকা তৈরি করে খেতে হবে। গর্ভাবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। তাই এর ঘাটতি পূরণে যে সকল খাবার খেলে সাহায্য হয় সে সমস্ত খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার
পালং শাক, কচু শাক, লাল মাংস, সুস্থ সবল দেশি মুরগির কলিজা, কাঠবাদাম, বিট খেজুর ইত্যাদি। এছাড়া বেদানাতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন ,কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার থাকে যা খেলে শরীরে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণ হয়। প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে বেদানা খাওয়া উচিত। মাছ,ডিম,শিং মাছ, কাঁচ কলা ইত্যাদি খাবারও প্রচুর পরিমাণ আয়রন রয়েছে।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়া ভিটামিন সি এর অভাবে দেখা দিতে পারে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ভিটামিন সি সহায়তা করে। তাই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার এই সময়ে বেশি বেশি খাওয়া উচিত । কমলা ,লেবু, স্ট্রবেরি, পেঁপে, বাতাবি লেবু ,ব্রুকলি ,গোলমরিচ ,টমেটো, আঙ্গুর, আমলকি, ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এই ধরনের খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।
প্রোটিন জাতীয় খাবার
গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা দূর করতে অবশ্যই বেশি পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম, ছোলা, সয়াবিন, ও দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। তাই গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা বাড়াতে এই খাবারগুলো খেতে হবে।
তবে সবচাইতে ভালো হয় এই সময়ে রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ জেনে সেই অনুযায়ী ঔষধ ও খাবার গ্রহণ করলে।
গর্ভাবস্থায় শরীর দুর্বল লাগে কেন
এ সময় শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোনের তারতম্য ঘটে। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে ও ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে। এছাড়া গর্ভকালীন সময়ের শেষ তিন মাসে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে শরীরে ক্লান্তি ভাব আসে।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় মুড়ি খেলে কি হয় | মুড়ি খাওয়ার ৫টি উপকারিতা
রক্তশূন্যতা দেখা দিলে করণীয়
- গর্ভধারণকালীন অবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
- আয়রন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন :ডিম, মাংস, কলিজা ,সবুজ শাকসবজি ,মটরশুঁটি, কলা,বেদানা,আমিষ জাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন জনিত ঔষধ খেতে হবে
- গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার করে হিমোগ্লোবিনের পরীক্ষা করতে হবে।
সর্বোপরিঃ গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে - গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কেনো হয়
বলতে হয় নারীদের জীবনে কর্মকালীন সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে উচিত সঠিক নিয়মকানুন মেনে স্বাস্থ্য সচেতন ভাবে জীবন যাপন করা। এতে করে গর্ভধারিণী এবং অনাগত শিশু দুজনেরই স্বাস্থ্যগত কল্যাণ সম্ভব। অনেক গর্ভধারিণী রক্তস্বল্পতা জনিত কারণে অকালেই মৃত্যু বরণ করে।
তাই মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর জন্য আমাদের স্বাস্থ্যগত সচেতনতা বৃদ্ধি ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভকালীন সময়ে পার করা উচিত। আশা করছি উক্ত আর্টিকেল এর মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে এবং কি কি করণীয় তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। ধন্যবাদ।
গর্ভাবস্থায় কি খেলে রক্ত বাড়ে সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্নঃ গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা কি মারাত্মক সমস্যা?
উত্তরঃ হ্যাঁ রক্তস্বল্পতা একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যা। যতটা সম্ভব এ সমস্যা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করা উচিত। নয়তো গর্ভ ধারণকারী এবং শিশু দুজনেরই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্নঃ গর্ভাবস্থায় রক্তে সল্পতা দেখা দিলে কি করব?
উত্তরঃ গর্ভকালীন সময়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরে রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রশ্নঃ গর্ভাবস্থায় রক্তসল্পতা পূরণে খাবার গ্রহণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তরঃ খাবারের মাধ্যমেই মূলত রক্তস্বল্পতার সমস্যা সমাধান সম্ভব। তাই যে সমস্ত খাবার খেলে রক্তস্বল্পতা দূর হয় সে সমস্ত খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। আয়রন যুক্ত ও ভিটামিন সি যুক্ত খাবার বেশি বেশি গ্রহণ করতে হবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url