কমলা গাছের পরিচর্যা - কমলার প্রচুর ফলন পেতে সঠিক পরিচর্যা
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হচ্ছে কমলা। নাস্তার টেবিলে ফল হিসেবে কমলার বিকল্প নেই। তবে যাদের নিজেদের বাসার ছাদে কিংবা বাগানে কমলার গাছ রয়েছে তারা কি জানেন কমলা গাছের পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়?
বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকেই কমলা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। আপনি যদি সঠিকভাবে কমলা গাছের পরিচর্যা করতে পারেন তাহলে আপনিও বাণিজ্যিকভাবে কমলা গাছের বাগান দিয়ে লাভবান হতে পারবেন। অথবা আপনি যদি এ-বাড়ির আনাচে-কানাচে খোলা ময়দানে কমলা গাছ লাগাতে চান তাহলে সেটাও করতে পারেন।
কমলা গাছ লাগাতে হলে অবশ্যই আপনাকে বেশ কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কেননা আপনি যদি সঠিক ভাবে কমলা গাছের পরিচর্যা না করেন বা কমলা গাছের যত্ন নিতে না পারেন, তাহলে কিন্তু কমলা গাছ সঠিক ভাবে বেড়েও উঠবে না এবং আপনি কাঙ্খিত ফলও পাবেন না।
তাই কমলা গাছ লাগানোর পূর্বে অবশ্যই আপনার উচিত হবে কমলা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া। চলুন জেনে নেয়া যাক কমলা গাছের পরিচর্যা,কমলা গাছের যত্ন এবং কমলা গাছের রোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
কমলা গাছ লাগানোর পদ্ধতি
কমলা গাছ লেবুজাতীয় একটি গাছ. এটি সাইট্রাস জাতীয় উদ্ভীদ অনেকেই মনে করে যে, কমলার বীজ থেকে কমলা লেবুর গাছ লাগানো যায়। মূলত কমলার বীজ থেকে যদি আপনি কমলার গাছ লাগাতে চান তাহলে কিন্তু সেই গাছ বড় হতে অনেক সময় নেবে এবং তাতে ফল ধরতে কত সময় লাগবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে আপনি যদি ভালো নার্সারি থেকে ভালো মানের কমলা লেবুর চারা নিয়ে লাগান তাহলে দেখা যাবে যে কয়েক বছরের মধ্যেই আপনি সেই গাছ থেকে ফল পাবেন। তবে অবশ্যই কিন্তু প্রয়োজন হবে কমলা গাছের পরিচর্যা। তাই কমলা লেবু গাছ লাগাতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে নার্সারি থেকে ভালো মানের কমলা লেবুর গাছ ক্রয় করে লাগাতে হবে।
কমলা গাছ লাগানোর পূর্বে আপনাকে কমলা গাছ লাগানোর জন্য মাটি প্রস্তুত করতে হবে।সেক্ষেত্রে ৬০×৬০×৬০ সেন্টিমিটার গর্ত করতে হবে। এবং সেই গর্তের মধ্যে ১০ কেজি পরিমাণ গোবর সার, ২০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার, ২০০ গ্রাম পরিমাণ এমপিও এবং ৫০০ গ্রাম পরিমাণ চুন প্রয়োগ করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ কমলার খোসার ১৫ টি উপকারিতা ও অপকারিতা ব্যবহার
সব সারগুলো দেয়া হয়ে গেলে আপনাকে ২০ থেকে ২৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এর পরে আপনি কমলা লেবুর চারা গুলো সেই গর্তে ভালভাবে লাগিয়ে দিন।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মাঝেমাঝে আপনাকে কমলা গাছ গুলোতে পানি দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। কমলা গাছের জন্য সেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই মাঝে মাঝেই সেই কমলা গাছে সেচ দিতে হবে। কমলা গাছ লাগানোর সময় আপনাকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে তা হলো এই গাছটি সাধারণত বর্ষাকালে লাগালে ভালো হয় এবং গাছ মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা।
তাই আপনি বর্ষাকালে গাছ লাগাবেন।এরপর গাছের গোড়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী সার দিতে হবে প্রত্যেকটি গাছে বছরে গড়ে ৪৫০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা উচিত এবং এর পাশাপাশি পটাশিয়াম ফসফরাস সহ অন্যান্য যুক্ত করা যেতে পারে।
মাঝে মাঝে কমলা গাছগুলোকে ছাঁটাই করতে হবে অর্থাৎ যে ডাল গুলো এলোমেলো অবস্থায় নিচের দিকে ঝুলে পড়ে সেই ডালগুলো কেটে সুন্দর করে রাখতে হবে এবং কাটা অংশগুলোতে ফাংগিসাইড লাগিয়ে দিতে হবে।
কমলার চারা নির্বাচন করা
কমলা চাষ করতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম ভালো মানের কমলা চারা নির্বাচন করতে হবে। চারা যৌন ও অযৌন পদ্ধতিতে কমলার বংশ বিস্তার করা যায়। কমলার বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যেতে পারে। কমলার একটি বীজ থেকে একাধিক চারা পাওয়া যায়।
তুলনামূলকভাবে সতেজ ও মোটা চারাসমূহ অযৌন চারা বা নিউসসেলার চারা হিসেবে পরিচিত। গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড়া কলমের মাধ্যমে অযৌন চারা উৎপাদন করা যায়। কমলা উৎপাদনের জন্য অযৌন চারা উত্তম।তাই আপনাদের উচিত অযৌন চারা বা কলমের চারা দিয়ে কমলা গাছ লাগানো বা কমলা গাছের বাগান শুরু করা।
টবে কমলা গাছের পরিচর্যা
আপনি যদি টবে কমলা গাছ চাষ করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে ভালোভাবে টবে কমলা গাছের পরিচর্যা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে কমপক্ষে ১.৫ থেকে ২ ফুট x ১.৫ থেকে২ ফুট সাইজের টপ বা ড্রাম ব্যবহার করতে হবে।
এর থেকে ছোট আকৃতির টবে বা ড্রামে চায়না কমলার চাড়া রোপণ করা উচিত নয়। কমলা লেবু গাছের পরিচর্যা বা টবে কমলা গাছের পরিচর্যা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হবে।
আরো পড়ুনঃ লেবুর ২৫ টি স্বাস্থ্য উপকারিতা ও অপকারিতা গুলো জেনে নিন
পরিমাণ মতো গোবর বা কম্পোস্ট ,ইউরিয়া সার, টিএসপি, এমওপি সার, জিংক সালফেট এবং সলুবোর বোরন সার গুলোকে একত্রে মিশ্রিত করে একটি মিশ্রন সার তৈরি করতে হবে। এর পরে সেই মিশ্রণ সার গুলো প্রতিটি টবে নির্দিষ্ট পরিমাণে দিয়ে দিতে হবে।
মাটিতে কমলা গাছের পরির্চযা
কমলা গাছ লাগানো বা বাগান করার জন্য অবশ্যই উচু জমি বা পাহাড়ি জমি হতে হবে। ভালো ফলন পেতে হলে কমলা গাছে সার প্রয়োগ করা দরকার। মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-চৈত্র (ফেব্রুয়ারি-মার্চ), বর্ষার আগে মধ্য-চৈত্র থেকে মধ্য-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল থেকে মে) এবং বর্ষার পরে মধ্য ভাদ্র-মধ্য কার্তিক মাসে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
চারা রোপণের ৩-৪ মাস পর গাছপ্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। মাটির উর্বরতার ও গাছের অবস্থার উপর ভিত্তি করে স্যারের পরিমাণ কমবেশি করে দিতে পারেন।
চারা গাছের গোড়ায় মাঝে মাঝে পানি দিতে হবে। বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে বৃষ্টির পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রেখে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।ছাঁটাইচারা অবস্থায় কমলা গাছের বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
গোড়া থেকে অতিরিক্ত জন্মানো শাখা কেটে ফেলতে হবে। নিচের দিকে ছোট ছোট শাখা ছেটে ভূমি থেকে অন্তত ৪৫ সেমি ওপর থেকে কাণ্ডের উৎপাদনশীল শাখা বাড়তে দেওয়া যেতে পারে। মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল মাঝে মাঝে ছেটে দিতে হবে। গাছের গঠন ছোট থেকেই সুন্দর ও শক্ত করে তুলতে হবে।আগাছা বেশ ক্ষতি করে।
গাছের গোড়ায় যাতে আগাছা জন্মাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাছের ওপরে পরগাছা ও লতাজাতীয় আগাছা থাকলে তা দূর করতে হবে। সঠিকভাবে কমলা গাছের পরিচর্যা করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
কমলার প্রচুর ফলন পেতে সঠিক পরিচর্যা
কমলা গাছের রোগ ও প্রতিকার
কমলা গাছের কিছু কমন রোগ রয়েছে এই রোগগুলো সম্পর্কে আপনি যদি না জানেন তাহলে আপনার রোপণকৃত কমলা গাছ অকালেই মরে যেতে পারে। নিচে কমলা গাছের রোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
• পাতা খেকো পোকা — আপনাদের রোপণকৃত কমলা গাছে যদি পাতা খাওয়ার জন্য পোকা বাসা বাধে তাহলে তা কমলা গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে আপনাকে ১০ মিলি মেটাসিস্টক্স ১০ লিটার পানিতে অথবা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করে গাছের পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে। তাহলে এই রোগ দূরীভূত হবে।
• বাকল ছিদ্রকারী পোকা — বাকাল ছিদ্রকারী পোকা কমলা গাছের বাকল গুলোকে ছিদ্র করে ফেলে এবং বাকলে রস পুরোপুরিভাবে শুষে নেয়। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে রিপকর্ড ১০ ইসি কীটনাশক ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ বা ১০ মিলি মিশিয়ে সারা গাছে স্প্রে করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ সকালে খালি পেটে কলা খাওয়ার উপকারিতা বিস্তারিত বিশ্লেষণ
• গ্রীনিং রোগ — এ রোগ দেখা দিলে আপনার কমলা গাছের পাতা হলুদ আকার ধারণ করবে এবং আস্তে আস্তে শিরা দুর্বল হয়ে পড়বে। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে, ম্যালাথিয়ন ০.০৪% অথবা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ১০ লিটার পানিতে ৫ চা চামচ মিশিয়ে সম্পন্ন গাছে স্প্রে করে দিতে হবে।
• ক্যাংকার রোগ — এ রোগে ফল ও পাতা আক্রান্ত হয়।এ ধরনের রোগ হলে ফল, পাতা কেটে ফেলতে হবে এবং মাঝে মাঝে বর্দোমিকচার ছিটিয়ে রোগ দমন করতে হবে।
• কমলা গান্ধী—ফলের গায়ে ছিদ্র করে রস চুষে খায়। মধ্য-ভাদ্র থেকে মধ্য-কার্তিক মাসে যখন ফল পুরো রসালো হয় তখন এ পোকার উপদ্রব শুরু হয়। এতে ছিদ্রস্থান কয়েকদিন পর হলদে হয়ে ফল ঝরে যায়।এ ধরনের রোগ দেখা দিলে ম্যালাথিয়ন ০.০৪% অথবা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ১০ লিটার পানিতে ৫ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করলে এ পোকা দমন করা যায়।
শেষকথাঃ কমলা গাছের পরিচর্যা - কমলার প্রচুর ফলন পেতে সঠিক পরিচর্যা
কমলালেবু জাতীয় ফলের মধ্যে কমলা সবচেয়ে জনপ্রিয়। সুস্বাদু, সুগন্ধি এবং ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল। বর্তমানে কমলা ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আমেরিকা ও বাংলাদেশে অধিক পরিমাণে উৎপাদন হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে আমাদের দেশেও উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেতে পারে। সঠিকভাবে কমলা গাছের পরিচর্যা করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
এটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল। কমলা সর্দিজ্বর ও বমি নিবারক। কমলার শুকনো ছাল অম্লরোগ ও শারিরীক দুর্বলতা নিরসন করে।উপরিক্ত আলোচনায় আপনারা কমলা গাছের চাষ করে বেকারত্ব দূর করতে পারবেন এবং স্বাবলম্বী হতে পারবেন।
কমলা গাছের পরিচর্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন : কমলা ফলে কোন ভিটামিন রয়েছে?
উত্তর : কমলা ফলে ভিটামিন সি রয়েছে। আর ভিটামিন সি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ত্বক ও চুলকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন : কোন জমিতে কমলালেবু গাছ ভালো হয়?
উত্তর : উচু বা পাহাড়ি জমিতে কমলালেবু গাছ ভালো হয়। তাই কমলা গাছ রোপনের পূর্বে অবশ্যই উঁচু জমি নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন। এতে ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব হবে।
প্রশ্ন : কমলালেবু চারা রোপনের ৩-৪ মাস পর কোন সার কত গ্রাম করে প্রয়োগ করতে হবে?
উত্তর : কমলালেবু চারা রোপনের তিন চার মাস পর প্রতিটি গাছে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ১০০গ্রাম টিএসপি ১০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url