যাকাত কার উপর ফরজ - কিভাবে বুঝবেন আপনার ওপর যাকাত ফরজ
কিভাবে বুঝবেন আপনার ওপর যাকাত ফরজ ? যাকাত ইসলামের ফরজ আমলের মধ্যে অন্যতম একটি ফরজ কাজ। যাকাত কার উপর ফরজ তা নির্ধারন হয় ইসলামী আইন অনুযায়ী। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেনঃ "সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের আবর্তিত না হয়" (সূরা হাশরঃ০৭)
কুরআন মজীদে যাকাতকে সাদাকাহ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর ইসলামী পরিভাষায় যাকাত আদায়কারীকে বলা হয়েছে মুসাদ্দিক। সাদাকাহ আরবী 'সিদৃক' শব্দ থেকে এসেছে; এর অর্থ হচ্ছে সত্যতা বা প্রমাণ। আজ আপনারা যাকাত সম্পর্কে যাবতীয় সকল তথ্য এই আর্টিকেলে জানতে পারবেন।
যাকাত কি?
ইসলামে যাকাত একটি বড় এবাদত। যাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। যাকাত একদিকে দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; অপরদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
কুরআন ও সুন্নায় যাকাত, সাদাকা ও উশর বলতে এক ও অভিন্ন জিনিসকে বুঝানো হয়েছে। আরবী 'যাকাত' শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, আধিক্য, ক্রমবৃদ্ধি ও প্রশংসা। সাদাকা শব্দটি আরবী সিদকা' শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে সত্যতা বা প্রমাণ; আর উশরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দশ ভাগের এক ভাগ।
ইসলামি পারিভাষিক অর্থে যাকাত, সাদাকা ও উশর বলতে সাহেবে নিসাবের ধন-মাল, জমির ফসল এবং খনিজ সম্পদের উপর ইসলামী শরীয়ত নির্ধারিত অবশ্য দেয় সেই অংশকে বুঝায় যা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার নিয়তে, ঈমানের সত্যতার প্রমাণ স্বরূপ সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন এবং সম্পদের ক্রম বৃদ্ধি আশায় আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত আটটি খাতে ব্যয়-বণ্টন করার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট তহবিলে দেওয়া হয় ।
যাকাতের উদ্দেশ্য?
সাহেবে নিসাব মুসলমানদের উপর যাকাত এ উদ্দেশ্যেই ফরয করা হয়েছে যে, আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ের মাধ্যমে তাদের অর্থ-সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, দাতার নিজের অন্তঃকরণ ও তার সমাজ কার্পণ্য, হিংসা-বিদ্বেষ, অসৎ প্রবণতা থেকে মুক্ত হবে এবং সমাজে প্রেম, ভালবাসা, কল্যাণ কামনা, সহানুভূতির গুনাবলী বৃদ্ধি ও প্রসার লাভ করবে।
একই সাথে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাস পাবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি উর্ধ্বমূখী হবে। ইসলামে যাকাত দেওয়ার মুল উদ্দেশ্য কি সেই বিষয়ে আল্লাহ বলেন-
خَذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُرَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صلاتك سكن لَّهُمْ وَاللهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ - أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ هُوَ يَقْبَل
التّوبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَأْخُذُ الصَّدقَاتِ وَأَنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ -
- "এদের সম্পদ হতে 'সাদাকা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি এদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে। এরা কি জানে না যে, আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং 'সাদাকা গ্রহণ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" [সূরা তাওবাঃ ১০৩-১০৪]
- "এবং তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।" [সূরা যারিয়াত- ১৯]
- আত্মীয়-স্বজনকে দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করোনা।" [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৬)
- "লোকে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বল, 'যা উদ্বৃত্ত'। এভাবে আল্লাহ্ তাঁর বিধান তোমাদের জন্য সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর। [সূরা বাকারা-২১৯) ৫। আল্লাহ তা'আলা যাকাত বিধানকে সম্পদের পবিত্রতা লাভের উপায় রূপে অবতীর্ণ করেন।" [বুখারী/১৩১৭-ই, আসলাম (রাঃ)]
- "তোমাদের প্রত্যেকের উচিত এক টুকরা খেজুর (সাদাকা) দিয়ে হলেও যেন আগুন থেকে আত্মরক্ষা করে। যদি কেহ তাও না পারে তাহলে যেন মিষ্টি কথা দিয়ে হলেও সে তা করে।" [বুখারী/১৩২৫-আ, ই, হাতিম (রাঃ)]
যাকাত কার উপর ফরজ/ যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি?
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি অথবা যাকাত কার উপর ফরজ সে সম্পর্কে অনেকরই কোন ধারনা নায়। তাহলে আপনি কেমন করে বুঝবেন আপনার ওপর যাকাত ফরজ? আপনাদের জন্য আমরা আজ এই তথ্য আপনাদের জানাবো, আসুন জেনে নিন যাকাত কার উপর ফরজ-
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত ৬ টি
- সম্পদের উপর সম্পূর্ন মানিকানা থাকলে যাকাত ফরজ।
- সম্পদ উৎপাদনহ্মম বা বৃদ্ধি পাওয়ার হ্মমতা থাকলে যাকাত ফরজ।
- নিসাব পরিমাণ সম্পদ বা ৭.৫ তোলা সোনা থাকলে যাকাত ফরজ।
- মৌল প্রয়োজনের অতিরক্ত সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ।
- ঋণমুক্ত থাকলে যাকাত ফরজ।
- সম্পদ এক বছর থাকলে যাকাত ফরজ।
কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হবে ?
যেহেতু আপন্রা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন যাকাত দিতে হলে কি কি শর্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আপনি এখন স্পষ্ট হতে পারেননি যে আসলে কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হবে ? যেগুলোর জন্য যাকাত ফরজ তা নিচে দেওয়া হলো-
- সোনা-রুপা
- নগত টাকা
- ব্যবসায়ের মালামাল
- জমির ফসল
- খনিজ সম্পদ
- গরু-মহিষ
- ছাগল-ভেড়া
- উট
- ঘোরা
- লব্ধ গুপ্তধন
কোন কোন সম্পদের যাকাত নেয় ?
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলো সম্পর্কে আলোচনা সময় ইসলামে যাকাত মুক্ত কিছু কিছু সম্পদ আছে যাদের যাকাত দিতে হয় না। যাকাত নেয় এমন সম্পদ হলো-
- জমি
- মিল/কারখানা/গুদাম ইত্যাদি
- দোকান
- বাড়ী-ঘর
- এক বছরের কম বয়সের গবাদি পশু
- ব্যবহারের যাবতীয় কাপড়-চোপড়
- বই-খাতা-কাগজ
- গৃহের যাবতীয় আসবাবপত্র,
- অফিসের যাবতীয় আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার ইত্যাদি
- গৃহপালিত সকল প্রকার মুরগী ও পাখী
- কল-কব্জা, যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ইত্যাদি যাবতীয় মূলধন সামগ্রী
- চলাচলের জন্তু বা গাড়ী
- যাকাত-বছরের মধ্যে পেয়ে সে বছরের মধ্যেই ব্যয় করা হয়েছে এমন যাবতীয় সম্পদ
- দাতব্য বা সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ যা জনগণের উপকার ও কল্যাণে নিয়োজিত
- সরকারী মালিকানাভুক্ত নগদ অর্থ, সোনা-রূপা এবং অন্যান্য সম্পদ।
যাকাত কখন দিতে হয় ?
রমজান মাস হছে যাকাত দেওয়ার সবচেয়ে উত্তম সময়। আমরা সকলেই জানি যে, অন্যান্য মাসের চেয়ে রমজান মাসের ভালো কাজগুলোর নেকি আল্লাহ তায়ালা কয়েক গুন বাড়িয়ে দেন। সেই কারনে রমজান মাসে যাকাত দিলে আপনি অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক নেকি পাওয়ার আশা রাখতে পারেন।
বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয় ?
ইসলামে ৫২.৫ তোলা রুপা ব ৭.৫ তোলা সোনা থাকলে যাকাত ফরজ হয়ে যায়। বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ সালের এক তোলা রুপার মুল্য হচ্ছে ১৮০০টাকা তবে ৯৪৫০০টাকা এবং এক তোলা সোনার মুল্য হচ্ছে ১ লহ্ম ১ হাজার ২৪৪ টাকা, তাহলে আপনার বর্তমানে ৯৪৫০০- ৭৫০৯৩৩০ টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হবে।
তাছারা, আপনার হাতে এবং ব্যাংকে রক্ষিত নগদ টাকা ছাড়াও সঞ্চয়পত্র ইত্যাদিও নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া পূর্বের বকেয়া পাওনা ঋণ, চলতি বছরে দেওয়া ঋণ এ সবকেও নগদ অর্থের মধ্যে ধরে যাকাত হিসাব করতে হবে।
তাছারা, আপনার হাতে এবং ব্যাংকে রক্ষিত নগদ টাকা ছাড়াও সঞ্চয়পত্র ইত্যাদিও নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া পূর্বের বকেয়া পাওনা ঋণ, চলতি বছরে দেওয়া ঋণ এ সবকেও নগদ অর্থের মধ্যে ধরে যাকাত হিসাব করতে হবে।
যে সব ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা নেই সেগুলো বাদ দেয়া যেতে পারে। তবে এ সব ঋণ যদি ফেরত পাওয়া যায় তাহলে তখন এর যাকাত দিতে হবে। প্রচলিত ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থায় যেহেতু সুদ আছে সে জন্য ব্যাংকে রক্ষিত সঞ্চয়, জীবন বীমা এবং সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত অর্থের মধ্য থেকে সুদ পৃথক করে দরিদ্রের মধ্যে দান করে দিতে হবে এবং বাকী অংশের উপর যাকাত দিতে হবে।
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব/ যাকাত সম্পর্কে হাদিস কি বলে ?
যাকাত প্রদানকারী যাকাত প্রদানের মাধ্যমে তার ঈমানের সত্যতারই প্রমাণ দিয়ে থাকে। রাসূল (সাঃ) হাদীসে বলেছেন, “সাদাকাহ্ হচ্ছে অকাট্য দলিল।" -(মুসলিম)
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, "যে সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করা হয় না, সে সম্পদ যাকাতের সাথে মিশে পরিণামে ধ্বংস হয়। (মেশকাত) অর্থাৎ যে ব্যক্তি যাকাত মিশ্রিত সম্পদ ভোগ করবে তার ঈমান বরবাদ হয়ে যাবে। তাছাড়া যেহেতু সে গরীবের হক মেরে খায়, ফলে আল্লাহ তার সম্পদ ধ্বংস করেও দিতে পারেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেছেন, "যেসব ভূমি বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে সিক্ত হয়, সে ভূমির উৎপন্ন ফসলের উশর (দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত) আদায় করতে হবে। আর যে সব ভুমিতে পানি সেচ করতে হয় তাতে উশরের অর্ধাংশ (বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত) আদায় করতে হবে। (বুখারী)
ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিম দাস, স্বাধীন ব্যক্তি, নর-নারী, এবং ছোট-বড় সকলের উপর সদকায়ে ফিতর (রোযার ফিতরা) এক সা' খেজুর কিংবা এক সা' যব নির্ধারণ করেছেন। এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, লোকেরা যেন (ঈদের) নামাজে যাবার পূর্বেই তা আদায় করে। (বুখারী) [হেজাযী এক 'সা' প্রায় আড়াই কেজির এবং ইরাকী এক 'সা' প্রায় তিন কেজি সাতশ গ্রামের সমান।]
লেখকের মন্তব্যঃ যাকাত কার উপর ফরজ - কিভাবে বুঝবেন আপনার ওপর যাকাত ফরজ
সম্পদের যাকাত আদায় করা হচ্ছে ফরজ ইবাদিত। যাকাত আসলে কোন দান না,যা কাউকে ভিখ্যা দেওয়া হয় বরং যাকাত হচ্ছে সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত দরিদ্রদের মৌলিক অধিকার বা হক। আশা করি আপনারা যাকাতের মুলভাবটিকে ভুজতে পেরেছেন।
যাকাত কার উপর ফরজ তা জানা সকল শ্রেনীর মুসলমানদের জন্য একটি কর্তব। আগামিতে আমরা আপনাদেরকে যাকাত দেওয়ার নিয়ম কি এবং কাদের যাকাত দেওয়া দরকার সেই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখব। আশা করি আমাদের আজকের আর্টিকেল পড়ে আপনি উপকৃত হতে পেরেছেন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url